ভাসমান পেয়ারার বাজারে একদিন









আমরা সন্ধ্যা নদীতে ভেসে ভেসে কুরিয়ানার খালে প্রবেশ করলাম। এর মধ্যেই সোহান নিয়ে এল দুঃসংবাদ। ট্রলারের মাঝি, ১৪ বছরের হৃদয়। সে নাকি যাত্রাপথের কিছুই চেনে না। আগে কয়েকবার এপথে যাতায়াত করায় তাই খুব একটা পাত্তা দিলাম না, তবে ভয় থেকেই গেল।

ভীমরুলি, কুরিয়ানা আটঘর বিখ্যাত ভাসমান পেয়ারা বাজারের জন্য। সারিসারি ভাসমান নৌকায় সবুজ হলুদ পেয়ারার ছড়াছড়ি। ক্রেতাবিক্রেতার হাঁকডাকে মুখরিত জায়গাটি এক বিস্ময় বটে।
ভিমরুলির জলবাজারের সে বিস্ময় দেখতে আগের দিন রাতে ঢাকা থেকে লঞ্চে বরিশালের পথে রওনা হই। ভোর চারটায় পৌঁছে যাই। সকাল ছয়টায় আমরা লঞ্চঘাট ছাড়ি। এখান থেকেই আমাদের সঙ্গী হন সোহানুর রহমান সোহান। ৫০ টাকা ভাড়ায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় চেপে চলে আসি নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে রিজার্ভ মহেন্দ্রোতে চেপে স্বরূপকাঠি খেয়াঘাট যখন পৌঁছি তখন সকাল প্রায় নয়টা। আর এখান থেকেই ৮শটাকায় ট্রলার ভাড়া করে আমাদের পানিপথে যাত্রা হয় শুরু। যেই ট্রলারের চালক হৃদয়।
 
আমরা হৃদয়ের ট্রলারে চেপে সন্ধ্যা নদী পেছনে ফেলে কুরিয়ানা খাল ধরে এগিয়ে চলেছি ভিমরুলি জলবাজারের দিকে। যেহেতেু খালটি কুরিয়ানার দিকে বয়ে গেছে, সেজন্য এলাকার লোকজন খালটিকে কুরিয়ানার খাল বলে।
 
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা স্বরূপকাঠি পেছনে ফেলে চলে আসি মাহমুদ কাঠি। মাহমুদ কাঠিতেও রয়েছে জলবাজার। মাহমুদ কাঠির জলবাজারে সব ধরনের গাছের চারা বিক্রি হয়। এই এলাকা পার হতেই আমরা এক অদ্ভূদ রূপের জগত প্রবেশ করি। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। যেন সবুজ রূপকথার রাজ্য।
 
আমাদের দৃষ্টিপথে ধরা দেওয়া সেসব সবুজের বেশিরভাগ হোগলা, সুপারি, আমড়া আর পেয়ারার বন। যতই সামনে এগুচ্ছি খাল ততই সরু হচ্ছে। বেশ লাগছিল ট্রলারে বসে ক্যামেরা ক্লিক করতে আর কুরিয়ানার সরুখালের আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
 
কুরিয়ানা খালের মোহিনী নিসর্গ আমাদের প্রায় বাকরুদ্ধ করে রাখল। ধীর গতিতে ট্রলার চলে আসল আদম কাঠি। এখানে এসে মাঝির কাছে জায়গার নাম শুনে আমার আরেক সঙ্গী চিৎকার করে বললেন, আরে এযে কাঠির মেলা। আমি ভাবি কাঠির মেলা হবে না কেনো- স্বরূপকাঠির পর পেলাম মাহমুদ কাঠি এরপর আদম কাঠি। এভাবেই এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম ঝালকাঠি। এটাই ভিমরুলি, জলে ভাষা পেয়ারার হাঁট বা জলবাজার।
 
দূর থেকে ভাসমান পেয়ারার বাজার দেখে মুগ্ধ আমার মুখ থেকে একটি মাত্র শব্দ বের হলআশ্চর্য
আমরা কুরিয়ানার খালে চলতি পথে দেখেছি গাছ থেকে পেয়ারা নামানোর দৃশ্য। লাইনকে লাইন ডিঙ্গি নাও বোঝাই করে পেয়ারা নিয়ে বাজারে নিয়ে আসার দৃশ্য। সব পূর্ণতা পেল ভিমরুলি এসে।
পেয়ারা আর কোষা নৌকা ছাড়া চোখে পড়ল না আর কিছুই। অবশ্য ব্যাপারিদের ট্রলার ছিল। ছিল পেয়ারার খরিদ্দার আর পেয়ারার মালিকের হাঁকডাক।
 
আমরা ঘন্টা তিনেক ভিমরুলির জলবাজার বা পেয়ারার হাঁটে ছিলাম। স্থানীয়রা যাকে বলে গোইয়ার হাঁট। বাজার ঘুরে ঘুরে পেয়ারা চাষি, ক্রেতা অতিথিদের উৎসব আকারের আনন্দ দেখলাম। আবার কষ্টও চোখে পড়ল।
 
সকালের দিকে পেয়ারা বিক্রি হচ্ছিল ৩শথেকে ৪শটাকা মন দরে। সেই পেয়ারাই বেলা পরার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হতে দেখলাম ১শথেকে ৬০ টাকা মন দরে।
সুদেব চাষি তাই কষ্ট বুকে চেপে বললেন, “বেচুম কি, দাম কইতে গিয়া কান্দন আহে। এক মন পেয়ারা ষাইট ট্যাকা হয়নি? কন দেহি দাদা!”

আমি আবার বাকরুদ্ধ হলাম। তারপর সারাদিনের আনন্দের সঙ্গে কষ্ট বুকে চেঁপে আটঘর কুরিয়ানা দিকে ট্রলার ভাসালাম।
প্রয়োজনীয় তথ্য
ভীমরুলি, কুরিয়ানা আটঘরের ভাসমান পেয়ারার বাজার দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে বরিশালের স্বরূপকাঠি।
ঢাকা থেকে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় প্যাডেল চালিত স্টিমার ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশ্যে। স্টিমারে চেপে বসতে পারেন অথবা রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে চলাচল করা ঢাকা-বরিশাল রুটের বিশাল সব লঞ্চ। সুরভী, কীর্ত্তনখোলা, সুন্দরবন নামের সে সব লঞ্চে এক বৃহস্পতিবার চড়ে বসলেই হল, বরিশাল পৌঁছে যাবেন।
 
তারপর নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে অটো রিকসা মহেন্দ্রো বা বাসে চেপে স্বরূপকাঠি। বাস ভাড়া মাথা প্রতি ৫০ টাকা। আর মহেন্দ্রো রিজার্ভ ৫শথেকে ৭শটাকা।
স্বরূপকাঠি থেকেই রিজার্ভ ট্রলারে সোজা ভীমরুলি যাওয়া যায়।

ভাসমানবাজার ঘুরে কুরিয়ানা হয়ে আটঘরের পেয়ারা বাজার দেখে ফিরতি পথ ধরবেন।
স্বরূপকাঠি ভাসমান পেয়ারা বাজার দেখার জন্য ট্রলার ভাড়া রিজার্ভ ৮শথেকে হাজার ২শটাকা।
ঢাকা-বরিশাল লঞ্চ ভাড়া ডেক ২শটাকা। কেবিন ডাবল হাজার ৮শটাকা নন এসি।
স্টিমারের ডেকের ভাড়া ৩শআর কেবিন ভাড়া ডাবল হাজার ২শনন এসি।

ডেক বাদে কেবিনে যেতে চাইলে আগে থেকে টিকিট বুকিং দেওয়া দরকার। কারণ, চাইলেই বরিশাল লঞ্চের টিকিট পাওয়া সম্ভব না।
আরেকটা কথা, বরিশাল নেমে ফেরার টিকিট কেটে নেবেন। অবশ্য ডেকের যাত্রী হলে সে সমস্যা নেই!
ছবি: লেখক।

Comments