এক যুগ পর কপিরাইট আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও গীতিকার-সুরকার-শিল্পী, সফটওয়্যার প্রকৌশলী ও লেখকরা উদ্যোগী না হলে তা কতোটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দিহান সরকারের কর্তাব্যক্তিরাই।
অংশীজনের
পরামর্শ নিয়ে
এরই মধ্যে
সংশোধনীর খসড়া
চূড়ান্ত করা
হয়েছে জানিয়ে
কপিরাইট বোর্ড
সভাপতি ও
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের
অতিরিক্ত সচিব
মসিউর রহমান
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন,
ওই খসড়া
আগামী ৩১
জুলাই আইন
মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন
তারা।
তবে অংশীজনরা
কপিরাইট নিয়ে
সচেতন না
হলে এ
আইন কতটা
কার্যকর হবে,
তা নিয়ে
সংশয় প্রকাশ
করেন তিনি।
মসিউর রহমান
বলেন, “১২
বছর পর
আইন সংশোধন
হতে যাচ্ছে।
কিন্তু যাদের
জন্য এ
আইন, তারা
যদি না
মানেন, তাহলে
এটা কতটা
কার্যকর করা
যাবে?”
তিনি জানান,
আইন অনুযায়ী
কপিরাইট নিবন্ধন
করা ঐচ্ছিক।
লেখক, সুরকার,
গীতিকার, সফটওয়্যার
প্রকৌশলীরা যদি
নিজেরা সচেতন
হয়ে নিজেদের
কাজের কপিরাইট
নিবন্ধন না
করান, তাহলে
তাদের জোর
করার সুযোগ
নেই।
“তারা
যদি সচেতন
না হন,
তাহলে সরকার
রাজস্ব হারাতেই
থাকবে। আর
পাইরেসি রোধে
আমাদের চেষ্টাও
কাজে আসবে
না।”
এ পর্যন্ত
কপিরাইট অফিসে
মেধাসম্পদ নিবন্ধনের
পরিসংখ্যান তুলে
ধরে কপিরাইট
বোর্ড সভাপতি
বলেন, বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের
তুলনায় এই
হার নগণ্য।
“কপিরাইটযোগ্য
মেধাসম্পদের হিসাব
করা হলে
শুধু এক
বছরেই বাংলাদেশে
মেধাসম্পদ রেজিস্ট্রেশন
হওয়ার কথা
১৫ হাজারের
বেশি। কিন্তু
আমাদের দেশে
এই হার
গড়ে পাঁচশর
কম। এটা
ক্রমশই কমছে।এ
কারণে সরকার
বড় ধরনের
রাজস্ব হারাচ্ছে।”
যুক্তরাষ্ট্র
ও ইউরোপীয়
ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর
মতো অনেক
উন্নত দেশে
জাতীয় আয়ের
একটি উল্লেখযোগ্য
অংশ মেধাস্বত্ত্ব
বিক্রি বা
রয়্যালিটি থেকে
আসে জানিয়ে
তিনি বলেন,
“ঈদ মৌসুমে
গানের বাজার,
একুশে বইমেলার
মৌসুমে প্রকাশক
এবং সফটওয়্যার
প্রকৌশলীররা মেধাস্বত্ব
নিবন্ধন করলে
সরকার বড়
অঙ্কের রাজস্ব
পেত। আর
বিটিআরসির কোনো
নীতিমালা না
থাকায় মোবাইল
অপারেটরদের থেকে
বড় অঙ্কের
রাজস্ব হারাচ্ছে
সরকার।”
কপিরাইট
নিবন্ধন করা
হলে সৃজন
কর্মের নৈতিক
ও আর্থিক
অধিকার অর্থাৎ
মালিকানা সংরক্ষণ
সহজ হয়।
আইন অনুযায়ী
কপিরাইট নিবন্ধন
বাধ্যতামূলক না
হলেও সৃজন
কর্মের মালিকানা
নিয়ে জটিলতা
দেখা দিলে
‘কপিরাইট নিবন্ধন
সনদ’ প্রমাণপত্র
হিসেবে আদালতে
ব্যবহৃত হতে
পারে।
মাত্র এক
হাজার ৬০০
টাকার বিনিময়ে
এই সনদপত্র
নেওয়ার সুযোগ
থাকলেও লেখক-শিল্পীরা
তা করছেন
না। বয়োজ্যেষ্ঠ
ও হালের
জনপ্রিয় অনেক
শিল্পীর সঙ্গে
কথা বলে
জানা গেল,
নিজেদের স্বার্থরক্ষার
এই সুবিধা
সম্পর্কে জানেন
না তারা।
শিল্পী-সুরকাররা
বলছেন, মিউজিক
কনটেন্ট প্রোভাইডারদের
সঙ্গে লিখিত
চুক্তির পর
তারা একটি
নির্দিষ্ট অঙ্কের
টাকা পান।
তারপর সেই
গান নিয়ে
কীভাবে ব্যবসা
হচ্ছে সেই
খবর রাখেন
না।
কিছু দিন
আগে ফরিদা
পারভীনের অনুমতি
ছাড়াই তার
গাওয়া তিনটি
গান বাজারে
বিক্রি হওয়ার
পর মেধাস্বত্ব
নিবন্ধন করেন
তিনি।
পরে তিনি
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন,
“দেরিতে হলেও
আমি আমার
মেধাস্বত্ব সম্পর্কে
সচেতন হয়েছি।
আমার সহশিল্পীরাও
আসবেন। আইনের
সুবিধাটুকু নিতে
সব শিল্পী
সচেতন হয়ে
উঠলে পাইরেসি
বন্ধ হবে
একদিন। আমাদের
ঠকিয়ে অনেক
ব্যবসা হয়েছে।
আর না।”
আরেক জনপ্রিয়
শিল্পী সাবিনা
ইয়াসমীনও সম্প্রতি
দুটি গানের
কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন
করিয়েছেন।
তিনি বলেন,
“এতদিন ধরে
আমরা কপিরাইট
নিয়ে সচেতন
ছিলাম না।
কনটেন্ট প্রোভাইডারদের
সঙ্গে চুক্তি
করতাম। আমরা
জানতাম না
কপিরাইট নিয়ে,
আগ্রহী ছিলাম
না।তবে কপিরাইট
নিয়ে বিএলসিপিএসও
সক্রিয় হচ্ছে।
এবার কপিরাইট
ইস্যুতে সংগীত
শিল্পীরা কোনো
ছাড় দেবে
না।”
সংগীতশিল্পীদের
অধিকার সুরক্ষায়
২০১৪ সালে
গঠিত হওয়া
বাংলাদেশ লিরিসিস্টস,
কম্পোজার্স অ্যান্ড
পারফর্মারস সোসাইটি
(বিএলসিপিএস) অনেক
দিন ধরেই
অকার্যকর।
এ বিষয়ে
বিএলসিপিএসের প্রধান
নির্বাহী কর্মকর্তা
সুজিত মোস্তফা
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন,
সম্প্রতি তারা
এই সংগঠনটিকে
কার্যকর করতে
সক্রিয় হয়েছেন।
এতে মুখ্য
ভূমিকায় অবতীর্ণ
হচ্ছেন ঢাকা
উত্তর সিটি
করপোরেশনের মেয়র
আনিসুল হক।
সুজিত মোস্তফা
বলেন, “শিল্পী-সুরকার,
গীতিকারদের সচেতনতার
অভাবে একদল
মধ্যস্বত্বভোগী বিভ্রান্তি
ছড়াচ্ছে। কপিরাইট
আইনেও সমস্যা
রয়েছে। কনটেন্টের
ট্যারিফ স্টেক
হোল্ডাররা কীভাবে
কত অংশ
পাবে, তা
নিয়ে স্পষ্ট
করে কিছু
বলা নেই।
রয়্যালিটি নিয়ে
হাজারো সমস্যা
রয়েছে।”
তবে এই
অভিযোগ মানতে
নারাজ কনটেন্ট
প্রোভাইডার মিউজিক
ইন্ডাস্ট্রিজ অব
বাংলাদেশের (এমআইবির)
সভাপতি নাজমুল
হক ভুঁইয়া।
তিনি বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে
বলেন, “নিশ্চয়ই
কোনো লিখিত
চুক্তি ছাড়া
আমরা কারও
গান রেকর্ড
করি না।
কপিরাইট আইন
মেনেই সব
চুক্তি করেই
আমরা ব্যবসা
করছি। হ্যাঁ,
ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টির
ক্ষেত্রে শিল্পী
ও গীতিকাররা
রয়্যালিটি মানি
পাবেন। কিন্তু
যখন তারা
আমাদের সঙ্গে
চুক্তি করছেন,
তার ব্যবসায়িক
দিকটি কিন্তু
আমাদেরই হয়ে
যাচ্ছে। এক্ষেত্রে
তাদের অভিযোগ
তো টিকছে
না। কপিরাইট
করব কি
না সেটা
তখন আমাদের
সিদ্ধান্ত।”
এ বিষয়ে
কপিরাইট অফিসের
রেজিস্ট্রার জাফর
রাজা চৌধুরী
বলেন, “লেখক-প্রকাশকদের
কপিরাইট নিবন্ধন
একান্ত ঐচ্ছিক।
কপিরাইট নিবন্ধনের
বিষয়ে তারা
সচেতন না
হলে সরকারও
ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিল্পী-লেখকরা
সচেতন হলে
আমরা পাইরেসি
রোধে অনেক
এগিয়ে যাব।কপিরাইট
অফিসকেও আরও
বেশি কার্যকর
করতে পারব।”
সম্প্রতি
কপিরাইট বিষয়ক
এক সভায়
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান
নূর বলেন,
মেধাস্বত্ব ইস্যুতে
শিল্পীদের তেমন
আগ্রহ না
থাকায় পাল্লা
দিয়ে বাড়ছে
পাইরেসি। পাইরেসি
রোধে সরকারের
নানা অভিযানও
তাই সফলতার
মুখ দেখছে
না।
হায়াৎ মামুদ,
যতীন সরকারের
মতো লেখকরাও
বলছেন, কপিরাইট
নিবন্ধন না
হওয়ায় তাদের
অনেক বই
একাধিকবার পাইরেসি
হচ্ছে। এ
বিষয় নিয়ে
প্রকাশকদের সঙ্গে
বারবার কথা
বলেও কোনো
লাভ হচ্ছে
না।
বাংলাদেশ
জ্ঞান ও
সৃজনশীল প্রকাশক
সমিতির সাবেক
সভাপতি ওসমান
গণি বলেন,
“কপিরাইটের বিষয়টি
পুরোপুরি নির্ভর
করে লেখকের
উপর, অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই গ্রন্থস্বত্ব
তাদের। তারা
যদি সচেতন
হয়ে ওঠেন
তবে আমাদের
বইয়ের পাইরেসি
কমে যাবে।
প্রায় অকার্যকর
হয়ে থাকা
কপিরাইট অফিসটি
সক্রিয় হলে
পাইরেসি কমবে
অনেকটাই। আইনি
প্রক্রিয়ায় তাদের
আরও কঠোর
হওয়া উচিৎ।”
সফটওয়্যারের
পাইরেসি নিয়ে
সোচ্চার হলেও
বিদ্যমান আইনে
সফটওয়্যারকে সাহিত্যকর্ম
হিসেবে দেখানোয়
অসন্তোষ জানান
বাংলাদেশ সফটওয়্যার
সমিতির সভাপতি
মোস্তাফা জব্বার।
আইন সংশোধন
করে ‘ডিজিটাল
রাইটস’ নিশ্চিত
হলে নিজেদের
দাবি-দাওয়া
তুলে ধরতে
একটি সংগঠন
করবেন বলে
জানান তিনি।
মোবাইল কনটেন্ট
প্রোভাইডারদের সঙ্গে
ক্রিয়েটরদের নানা
দ্বন্দ্ব নিয়ে
মোস্তফা জব্বার
বলেন, ভ্যালু
অ্যাডেড সার্ভিস
গাইডলাইন চূড়ান্ত
হলে রয়্যালিটি
মানি ইস্যুর
সুরাহা হবে।
মশিউর রহমান
জানান, ১৯৬২
সাল থেকে
২০১৭ সালের
১৭ এপ্রিল
পর্যন্ত গত
৫৫ বছরে
কপিরাইট অফিসে
মেধাসম্পদ রেজিস্ট্রেশন
হয়েছে ১৫
হাজার ৮১টি।
২০১৫ সাল
থেকে মাত্র
দুটি শিল্পকর্ম,
১১টি সাহিত্যকর্ম,
তিনটি সংগীত
ও আটটি
সফটওয়্যার নিবন্ধিত
হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল
প্রপার্টি রাইটস
ইনডেক্স-২০১৬
অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী
কপিরাইট সংরক্ষণে
১২৮টি দেশের
মধ্যে বাংলাদেশের
অবস্থান ১২৬তম।
এশিয়া প্রশান্ত
মহাসাগরীয় অঞ্চলের
২০টি দেশের
মধ্যে বাংলাদেশের
অবস্থান ১৯তম।
কপিরাইটকৃত
কর্মের অর্থনৈতিক
মূল্যমান সম্পর্কেও
এখন পর্যন্ত
দেশে কোনো
পরিসংখ্যান না
হওয়ার কথাও
উল্লেখ করেন
কপিরাইট বোর্ড
সভাপতি।
তিনি বলেন,
মেধাসম্পদের জগতে
শৃঙ্খলা ফিরিয়ে
এনে সুষ্ঠু
ব্যবস্থাপনা করা
গেলে তা
দেশের জাতীয়
আয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন
করতে পারে।
সে কারণেই
আইন সংশোধনের
উদ্যোগের কথা
জানিয়ে তিনি
বলেন, সংশোধিত
আইনে কপিরাইট
আইন ভঙ্গের
শাস্তি বাড়ানোর
প্রস্তাব করা
হয়েছে।
এতে কপিরাইট
অফিসের প্রশাসনিক
ক্ষমতা বৃদ্ধির
ওপর সর্বোচ্চ
গুরুত্ব দেওয়া
হয়েছে বলে
জানান রেজিস্ট্রার
জাফর রাজা
চৌধুরী।
তিনি বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে
বলেন, কপিরাইট
অফিস এতদিন
দেওয়ানি আদালতের
আদলে কাজ
করলেও এবার
তারা ফৌজদারি
অপরাধের বিচারের
ক্ষমতা চাইছে।
বিদ্যমান
আইনে কোনো
লেখক বা
প্রণেতার বই
বা কোনো
সৃষ্টিকর্ম কেউ
নকল করলে
তিনি দেওয়ানি
ও ফৌজদারি
উভয় প্রতিকার
চাইতে পারেন।
শাস্তি হিসেবে
কপিরাইট ভঙ্গকারীর
সর্বোচ্চ চার
বছর এবং
সর্বনিম্ন ছয়
মাসের কারাদণ্ড
হতে পারে।
পাশাপাশি সর্বোচ্চ
দুই লাখ
এবং সর্বনিম্ন
৫০ হাজার
টাকা জরিমানার
বিধান রয়েছে।
Comments
Post a Comment